Friday, November 11, 2011

‘তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়’

আমার ছোট বোনের নাম তাহিয়া। মডেল হবার খুব শখ। জিমটিম করে লম্বায় আমার থেকেও প্রায় এক বিঘৎ ছাড়িয়ে গেছে। না খেয়ে ‘শকুনির শরীর’ বানিয়েছে এরই মধ্যে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। কড়া শাসনে এখনো পড়ায় ধরে রাখা গেছে, কিন্তু আশঙ্কা করি, সামনে ভার্সিটিতে ভর্তি হলে ততো আর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। হয়তো মিডিয়া জগতে নেমেই যাবে। মডেল তাহিয়া আদৃতার মৃত্যুতে আমার ছোট বোনের কথাই মনে পড়লো সবচেয়ে বেশি করে। মনে হলো, এক বছর পর আমাকেও কি থানায় গিয়ে ছবি দেখে চিহ্নিত করতে হবে সহোদরাকে? কলগার্ল, পতিতা কিংবা নষ্ট মেয়ে পরিচয়ে আঞ্জুমান দাফন করবে তার লাশ?

এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিজ্ঞাপন কিংবা পারফর্মিং আর্টসে মেয়েদের মোহনীয় উপস্থাপন আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এই পুজিঁভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাতেও তো মডেলিং কিংবা পারফর্মিং আর্টস ‘শিল্প’ এবং ‘কাজ’ হিসেবেই তো স্বীকৃত। কিন্তু সে কাজের প্রক্রিয়া কেন হবে এমন জঘন্য এবং চোরাপথে? কেন প্রতিটি পথে পথে মুখোশধারী ‘জাদুকরেরা’ ‘পোড়ামুখী’দের কাগজের ফুল বানিয়ে দিতে এমন ফাঁদ পেতে বসে থাকবে?

আদৃতার মৃত্যু সত্যিই আমাকে অপরাধী করে দেয়। মুখোশধারী এইসব জাদুকরদের হাত থেকে বোনদের বাঁচাতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের এই মুখোশ উন্মোচন পর্ব-২।

----------------------------------------------

আদৃতাকে নিয়ে প্রথম লেখাটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।  শুধু এই ব্লগেই লেখাটি সাড়ে ৬ হাজার বার পড়া হয়েছে, এছাড়াও লেখাটি অন্যান্য ব্লগ এবং ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। সবমিলিয়ে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ লেখাটি পড়েছেন বলে ধারণা করা যায়। বিভিন্ন ব্লগ এবং ফেসবুকে এই লেখাটি নিয়ে মন্তব্য এসেছে ১ হাজারেরও বেশি। মন্তব্যগুলোতে কয়েকজন ব্যক্তি সম্পর্কে আরো তথ্যের জন্য আহ্বানও ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনুরোধ এসেছে আনিসুজ্জামান আনিস সম্পর্কে। স্টাইলপার্ক নামে একটি কাপড়ের দোকানের মালিক আনিসুজ্জামান মেয়েদেরকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তার খপ্পরে নিয়ে আসে এবং তারপর মেয়েদেরকে ‘ব্যবহার’ করে বলে মন্তব্যকারীরা জানিয়েছেন। মন্তব্যকারীদের অনুরোধে আমরা আনিসুজ্জামানের ইমেইল এবং ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করি। সেখানে মেয়েদেরকে প্রলোভন দেখানোর নানা প্রমাণ পেলেও (অন্তত অনলাইন কার্যক্রম থেকে) তাহিয়া তাবাসসুম আদৃতা-র সাথে তার ‘বিশেষ’ সম্পর্কের কোনো সন্দেহাতীত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কাজেই এই ‘মৃত্যু’র সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক আছে কিনা, সে বিষয়ে আমরা কোনো বক্তব্য দিতে পারছি না।

মন্তব্যকারীদের অনুরোধে আমরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত বেশ কিছু ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ও কাপড়ের দোকানের মালিকের ইমেইল এবং ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করি। তাদের অনলাইন কার্যক্রম থেকে দেখা যাচ্ছে, এরা প্রত্যেকেই মডেলিং-এর প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েদেরকে (সাধারণত যাদের বয়স ১৫-২৫) কব্জা করার চেষ্টা করে। এই ‘মেয়েধরা’রা একজন আরেকজনের কাছে ওই মেয়েদের পরিচয় করিয়ে দেয় ‘নতুন মাল’ হিসেবে। একজন আরেকজনকে জানিয়ে দেয়, মেয়েটির ‘দুধের সাইজ’ এবং স্পর্শকাতর নানা বিবরণী।

বিস্তারিত আগামীকাল।

Sunday, November 6, 2011

মডেল আদৃতার মৃত্যু : অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষ থেকে একটি ময়নাতদন্ত

মডেল আদৃতা মারা গেলেন। চরম অনাদরে তার লাশ পড়ে রইলো একটি বাড়ির চারতলার সিঁড়িতে। অনাদরেই দাফন হলো তার, কোনো পোস্টমোর্টেম হলো না। পরিবারের সদস্যরা শেষবারের মতো দেখতেও পেলেন না তার মরদেহ। লাশের ছবি দেখে দেখে স্বজনেরা শনাক্ত করেছেন তাকে। কী নির্মম এই পরিণতি!
পুলিশের নিস্পৃহতা নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে কথাও উঠেছে। কালের কণ্ঠ প্রশ্ন তুলেছে- “কলগার্ল পরিচয়ে কেন কবর হলো মডেল আদৃতার?” জবাব নেই এই প্রশ্নের। আদৃতা যদি একজন কলগার্ল কিংবা পতিতাও হয়ে থাকে, তবু একটি প্রাণের মৃত্যু নিয়ে কোনো ভাবনা নেই আমাদের রাষ্ট্রের?

মূলধারার গণমাধ্যম এবং প্রশাসন যখন ভিন্নভাবে, ভিন্নখাতে চিন্তা করছে এই মৃত্যুটিকে, তখন আদৃতার ফেসবুক অ্যাক্টিভিটি অনুসরণ করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা তৈরি করেছেন ভিন্ন একটি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট।

যেসব ব্যক্তিদের সাথে মডেল আদৃতার খাতির ছিল, তাদের অন্যতম আনন্দদিন পত্রিকার সম্পাদক বাশারুল ইসলাম মুন্না। মৃত্যুর দুই সপ্তাহ আগেও ফেসবুকে তার সাথে চ্যাট করেছেন আদৃতা। এর আগেও তাদের মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। কথাবার্তা খুবই সন্দেহজনক। মডেলিং এবং ক্যারিয়ারে উন্নতি করার জন্য সারা রাত মুন্নার সাথে থাকতে হবে আদৃতাকে। মুন্নার এই প্রস্তাবের জবাবে আদৃতা জানায়- ফ্যামিলির সাথে থাকে সে, সারা রাত থাকা সম্ভব না, তবে সন্ধ্যায় হলে পারবে (ছবি-১)। পরে অবশ্য আসতে রাজি হয় সে, জানায়- রাত ১০ টা পর্যন্ত থাকবে (ছবি-২); রাতযাপনের কারণ হিসেবে জানায়, হাতে টাকা নেই, টাকা দরকার।

ছবি-১


ছবি-২


টাকার সংকটটা আদৃতার ছিল বরাবরই। নতুন মডেলদের প্রায় সবারই এটা একটা সাধারণ সমস্যা। আদৃতার ফেসবুক বন্ধু তাহেরা ফাতেমার সাথে কথোপকথন (ছবি-৩) থেকে জানা যাচ্ছে, ডেইলী স্টারের ঈদ ফ্যাশন ম্যাগাজিন ২০১১ এবং আইস টুডেতে ফ্যাশন হাউজ “শাঁওলী’জ ডিজাইন”-এর পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য মডেল হন আদৃতা এবং হৃদি। ডেইলী স্টারের ঈদ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছে সেই ছবি, আর শাঁওলী’জ ডিজাইনের ফেসবুক পেজে এখনো প্রচ্ছদ ছবিটা আদৃতার। এই মডেলিং-এর জন্য যোগাযোগটা হয় হৃদির মাধ্যমে, কথা ছিল ২ জন মডেল ২৫০০ করে ৫০০০ টাকা পাবেন। কিন্তু হৃদির মাধ্যমে যেহেতু যোগাযোগ হয়েছে কাজেই, সে সেখান থেকে ১০০০ টাকা কেটে রাখে। আদৃতার হাতে আসে মাত্র ১৫০০ টাকা।

ছবি-৩































শুধু যে অর্থেই প্রতারিত হন আদৃতারা তাই নয়, প্রতারিত হন মডেলিং করতে গিয়েও। যেমন মুন্না কাজ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মডেলকে সারা রাত তার সাথে থাকতে বলেন, তেমনি কাজের জন্য অনেকে প্রেমের অভিনয়ও করে মডেলের সাথে। তেমনটিই করেছে এই মডেলের কথিত প্রেমিক রেহান। আদৃতার ফেসবুক বন্ধু ফয়সাল তুষারের সাথে কথোপথন থেকে জানা যাচ্ছে, তার এই প্রেমিক রেহান, যিনি নিজেও একজন মডেল, সে কাজ পাওয়ার জন্য বিভিন্ন নারী মডেলের প্রেমিক সেজে প্রেমের ভাণ করে (ছবি-৪)। দুঃখজনক হলেও সত্যি আদৃতা ভেবেছে, সত্যি সত্যিই হয়তো তাকে ভালবাসে রেহান, রেহানের সাথে রাতের পর রাত কাটিয়েছে সে, বাড়িতে বলেছে থাকছে বন্ধুর বাসায় (ছবি-৫)। অথচ ফেসবুকে যখন রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে “ইন এ রিলেশনশিপ উইথ রেহান” লিখেছে তখনই ফেসবুকের বন্ধুতালিকা থেকে আদৃতাকে রিমুভ করে দিয়েছে রেহান, শুধু তাই নয় নানা জনকে দিয়ে ফোন করিয়ে আদৃতার প্রোফাইল থেকেও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস সরিয়ে নিতে করতে বাধ্য করিয়েছে (ছবি-৬)। আদৃতার আরেক ফেসবুক বন্ধু ফয়েজ উদ্দিন সিফেল-এর সাথে কথোপথন থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু একসাথে থাকাই না, একসাথে ইয়াবাও খায় দুজনে। ইয়াবা খাওয়াকে তারা বলে পিপি খাওয়া অথবা ক্লাস করা।

ছবি-৪

ছবি-৫
ছবি-৬


কিন্তু এই বয়ফ্রেন্ডকেই শেষমেষ গোপনে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে আদৃতা। কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরই বুঝতে পারে, আসলে ভুল করেছে সে। উপরন্তু কোনো এক ঘটনায় (সে ঘটনা অবশ্য এখানে অনুল্লেখিত) তাকে মারেও রেহান। কাজেই ডিভোর্স দিতে চায় তাকে। ব্যবসায়ী ফারহান আহমেদ ওরফে ‘খালুজান’-এর সাথে আলাপে এসব জানায় আদৃতা। ফারহান ডিভোর্সের প্রক্রিয়া বাৎলে দেয় আদৃতাকে (ছবি-৭)। নিউ মার্কেটে ‘সাজ সম্ভার’ নামে একটা দোকানের মালিক ফারহানের মোহাম্মদপুরে 'লরেঞ্জো' নামে ৩ টি সাইবার ক্যাফে আছে। কিন্তু এই ব্যবসা করে কক্সবাজারে ফাইভ স্টার হোটেলের মালিক কি করে হলো, সেটা একটা রহস্য। অবশ্য সেই রহস্য দূর হয়ে যায় আদৃতার সাথেই আরেকটি আলাপচারিতায়। সেখানে আদৃতাকে বনানীর একটি হোটেলে কিছু ফটো তোলার প্রস্তাব দেয়, স্বল্প বসনে তুলতে হবে সেই ছবি (ছবি-৮), বিশেষ জায়গায় গিয়ে বিশেষ ধরনের এই ছবি তোলার নাম ‘পিকনিক’। বনানীর হোটেলে তোলা সেই ছবির কিছু কিছু পাওয়া যায় আদৃতার ফেসবুক প্রোফাইলে, আবক্ষ নগ্ন সে, কোনো কোনোটাতে নিম্নাংশে একটি তোয়ালে জড়ানো, কোনো কোনোটাতে নিম্নাংশ একেবারেই অস্পষ্ট (ছবি-৯)। এই ছবিগুলো আদৃতাকে দিয়েছে ফারহান, কিন্তু এগুলোর বাইরে আরো বেশ কিছু ছবি তুলেছে সে, বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও সেগুলো কোনোভাবেই দিতে রাজি হয়নি ফারহান।

ছবি-৭

ছবি-৮


































ছবি-৯


ঘটনার এখানেই শেষ নয়। কয়েকদিন পর আদৃতাকে আবারো ছবি তোলার কথা জানায়, এবারে কক্সবাজারে। আদৃতা যেতে পারবে না জানালে ফারহান বলে- “তা হলে তোমার মতো অসভ্য পোজ দিতে পারবে এমন কোনো নারী মডেল দাও” (ছবি-১০)। টাকার কথা শুনে শেষ পর্যন্ত আদৃতা নিজেই রাজি হয় (ছবি-১১)। কিন্তু শর্ত থাকে কোনোভাবেই তার বিবাহিত স্বামী রেহানকে জানানো যাবে না। কক্সবাজারে তিন দিন থাকার ব্যাপারটাকে বাড়ি থেকে রাগ করে কোনো বন্ধুর বাসায় থাকা এবং অভিমানে ফোন বন্ধ করে রাখা বলে চালিয়ে দেয় আদৃতা। পিকনিকে প্রতিবার মদ নিয়ে যান ফারহান, কিন্তু রোজার মাস বলে আগস্টে মদ না খেয়ে গাঁজা খাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা (ছবি-১২)। শুধু তাই নয়, ইয়াবাসক্ত আদৃতা ফারহানকেও ইয়াবা সেবনে প্রলুব্ধ করে (ছবি-১৩)। কক্সবাজারের ছবিগুলোতেও আগের মতোই নগ্ন, অর্ধনগ্ন দেখা যায় আদৃতাকে। এবারেও আগের মতোই বেশ কিছু ছবি বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও দেয়নি ফারহান, জানায়- “স্লো সাটার স্পিড থাকার কারণে ছবি নষ্ট হয়ে গেছে” (ছবি-১৪)। আদৃতাও আর পীড়াপীড়ি করেনি। জানা যায় না, তবে অনুমান করা যায়, এইসব ছবি (এবং হয়তো ভিডিও) নিয়ে ভালভাবেই ফারহানের খপ্পরে পড়ে আদৃতা। তার জন্য 'অসভ্য মেয়ে' খুঁজতে হয় তাকে। বন্ধু আসাদুজ্জামান আসাদকে লেখা মেসেজে তাই আদৃতা অনুরোধ করছে- “একটা মাল দাও না নিউ” (ছবি-১৫)।

ছবি-১০

ছবি-১১


  


ছবি-১২


































ছবি-১৩


































ছবি-১৪




























 




ছবি-১৫

































শেষ রক্ষা হয়নি অবশ্য। বিপত্তি বাধায় রেহান। বুঝতে পারে, ফারহানের সাথে বিশেষ কিছু ঘটছে আদৃতার। ফেসবুক থেকে ফারহানকে রিমুভ করতে বলে। আদৃতা সেটা করেও। মৃত্যুর এক বা দু’দিন (যেহেতু মৃত্যুর সঠিক সময় নিশ্চিত হয়নি এখনো) আগে ফারহানকে পাঠানো শেষ ফেসবুক মেসেজে আদৃতা জানায়- রেহান ফারহানের সাথে তার সম্পর্ক মেনে নিতে পারছে না, তাই তাকে ডিলিট করে দেয়া হলো (ছবি-১৬)। একই দিন ফয়সাল তুষারকে আদৃতা জানায়, রেহানের সাথে গোপনে বিয়ের ঘটনা বাসায় জানাজানি হয়ে গেছে, এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হচ্ছে (ছবি-১৭)।

ছবি-১৬
ছবি-১৭

































এই ঘটনার পরের দিন থেকেই নিখোঁজ আদৃতা। তারপরের ঘটনা...